শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৩২ অপরাহ্ন
কথাসাহিত্যিক মণিরত্ন মুখোপাধ্যায় শুক্রবার দুপুরে নতুন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে তাঁর বাসভবনে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। স্বল্প কয়েকদিনের অসুস্থ অবস্থার মধ্যেই খুব অপ্রত্যাশিতভাবে চলে গেলেন তিনি। মণিরত্ন মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৪০ সালে বীরভূম জেলার সিউড়ির কাছে মুকুরিয়া গ্রামে। শৈশবে তাঁর বাবার চাকরিসূত্রে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং দেশভাগের পর বাঁকুড়ায় কেটেছে কয়েক বছর। পরে চুঁচুড়ায় থেকে হুগলির মহম্মদ মহসীন কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে সাম্মানিক-সহ স্নাতক হন। রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পূর্ণ করার পর ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেই তাঁর চাকরি জীবনের শুরু। শৈশব-কৈশোরে গ্রামজীবনের নানান বৈচিত্র্যের মধ্যে কেটেছে তাঁর দিন। বেশ কয়েকবার জলে ডুবে যেতে যেতে ফিরে এসেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে। কৈশোরেই মুর্শিদাবাদের আহিরন থেকে কলকাতার আহিরীটোলা পর্যন্ত ৭১ কিমি সাঁতার প্রতিযোগিতায় সাঁতার কাটার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাও ছিল তাঁর। তখনকার মানুষ ও জীবন দেখার অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তাঁর বহু ছোটগল্পে। চাকরিসূত্রে ঘুরেছেন সারা ভারত এবং বিদেশের বহু দেশ। শেষে দিল্লিতে স্থায়ীভাবে বসবাস। গত ৪০ বছর ধরে প্রায় ৫০০ গল্প লিখেছেন। লিখেছেন বেশ কিছু উপন্যাস আর ভ্রমণ কাহিনী। পশ্চিমবঙ্গের নামী সমস্ত পত্রপত্রিকা থেকে বহু লিটল ম্যাগাজিনেও নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা। তাঁর প্রথম লেখা গল্প ‘কৃষ্ণতিল’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায়। তাঁর ‘গল্পসংগ্রহ’-সহ অন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো ‘অন্য মরুস্থলী’, ‘লুপ্ত সরস্বতী’, ‘নবিশ’, ‘অম্বা’, ‘ঠিকানা জোড়া মন্দিরতলা’, ‘মানুষ যখন পণ্য: দাস-ব্যবসার ইতিবৃত্ত’ ইত্যাদি। বিভিন্ন বিচিত্র বিষয় নিয়ে ছিল তাঁর লেখালেখির জগত। জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র বাংলায় অনুবাদ করেছেন ‘ভারতবর্ষ আবিষ্কার’ নামে। তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘অবরিগাদো ব্রাজিল’ নিছক ব্রাজিল ভ্রমণের কাহিনী নয়। ব্রাজিল বলতে কোপাকাবানা সী-বিচ, সুগারলোফ পাহাড় বা ইগুয়াসু জলপ্ৰপাতের কথা মনে পড়ে। কিন্তু সেসবের সঙ্গে সেখানকার সমাজ, খাবারদাবার, ইতিহাস নিয়ে উঠে এসেছে মূক-বধির ফার্নান্দো, প্রেমিক-পরিত্যক্ত একাকী হেঙ্কেল, সেরজু কিংবা হোটেলের রিসেপশনিস্ট মারিয়া গঞ্জালেসের মতো এক-একটি চরিত্র, যার ফলে এই লেখা নিছক ভ্রমণ কাহিনী নয়, কথাসাহিত্যের ভিন্নতর মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। দিল্লি শহরের বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে তরুণ কবি-লেখকদের সঙ্গে ছিল তাঁর অত্যন্ত গভীর আন্তরিক সম্পর্ক। করোনা-কালের আগে প্রায় নিয়মিত সাহিত্যানুষ্ঠানগুলিতে তিনি উপস্থিত থাকতেন, প্রাণিত করতেন তরুণদের। বছর দেড়েক আগে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি একাই থাকতেন। লেখালেখি এবং পড়াশোনার মধ্যেই কাটত তাঁর দিনরাত্রি। কাশীখণ্ড পুঁথির পূর্বার্ধ অংশের পঁচিশ হাজার শ্লোক সরল বাংলায় অনুবাদ করেছেন গত দু-বছর ধরে। প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার একটি বইয়ের এই খসড়া অপ্রকাশিত থেকে গেল। নতুন একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন,অসমাপ্ত থেকে গেল তা-ও। তাঁর মৃত্যুসংবাদে দিল্লির সাহিত্যমহলে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। আর সকলের মতো তিনি আমারও ‘মণিদা’ ছিলেন। গত কয়েক বছরে দিল্লিতে যত অনুষ্ঠানে, সাহিত্যের আড্ডায়, বইমেলায় তাঁকে পেয়েছি, সেসব আজ স্মৃতির পৃষ্ঠায় উঠে গেল। এরপর আর দিল্লি গেলে তাঁকে দেখব না ভাবতে পারছি না। অত্যন্ত মধুর-স্বভাব, সংবেদনশীল এই মানুষটির প্রয়াণে দিল্লির সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি তো বটেই, সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একটি যুগের অবসান ঘটল।
— সৈয়দ হাসমত জালাল